শিশু-কিশোরদের ডায়াবেটিস

0
39

 

শৈশবে যেসব অসুস্থতা শিশুর মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে ডায়াবেটিস মেলাইটাস তার মধ্যে অন্যতম। শরীরের কোষগুলোকে বেঁচে থাকতে ও জৈবনিক বিক্রিয়াগুলোকে পরিচালিত করতে শক্তি দরকার হয় যা কোষগুলো গ্লুকোজ থেকে পায়। অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত হরমোন, ইনসুলিন রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং কোষের ভেতরে গ্লুকোজের প্রবেশ ও কোষে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে। ইনসুলিন ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। যদি কোন কারণে দেহে ইনসুলিনের পরিমাণ কমে যায় বা ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করতে না পারে তবে গ্লুকোজ দেহকোষের বাইরে জমা হয় এবং একটা সময় পর এই গ্লুকোজ প্রসাবের সঙ্গে বের হয়ে আসতে থাকে। অধিকাংশ শিশুর ডায়াবেটিস হয় অগ্ন্যাশয়ের প্রয়োজনীয় পরিমাণ ইনসুলিন তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে (টাইপ১ ডায়াবেটিস)। এছাড়া ইনসুলিন যথেষ্ট পরিমাণে নিঃসৃত হওয়ার পরও যদি তা যথাযথভাবে কাজ করতে না পারে তাহলেও ডায়াবেটিস (টাইপ২ ডায়াবেটিস) হয়। এক্ষেত্রে যেসব কোষের ওপর ইনসুলিন কাজ করে তার সমস্যা থাকতে পারে বা ইনসুলিনের নিজেরও গঠনিক সমস্যা থাকতে পারে। এসব রোগীর দেহে ইনসুলিনের বিপক্ষে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। আবার কিছু শিশু-কিশোর টাইপ১ ও টাইপ২ উভয় প্রকার ডায়াবেটিসেই একসঙ্গে আক্রান্ত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে কার্যকরণের ওপর ভিত্তি করে ডায়াবেটিসকে নিম্নরূপে শ্রেণীবিন্যাস করা হয়ে থাকে।

টাইপ ১ ডায়াবেটিস : এই ডায়াবেটিসে অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলো (ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষ) বিনষ্ট হয়ে থাকে। অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলোর ধ্বংসের কারণ দেহের ভেতরেও থাকতে পারে (ইমিউন মেডিয়েটেড ডায়াবেটিস মেলাইটাস) আবার অজানা কারণেও বিটা কোষ ধ্বংস হতে পারে।

টাইপ ২ ডায়াবেটিস : এ রোগে দেহের ভেতরে ইনসুলিনের কার্যক্রমের বিরোধী প্রক্রিয়া চালু হয়ে থাকতে পারে। ফলে ইনসুলিন নিঃসরণের হার আগের মতোই বা এর চেয়ে বেশি থাকলেও ইনসুলিনের অভাবে দেহে যেসব অবস্থা হয় সেরূপ অবস্থাগুলো পরিলক্ষিত হতে থাকে। অর্থাৎ এখানে ইনসুলিনের আপাত ঘাটতি থাকে।

সন্তান গর্ভধারণ সম্পর্কিত ডায়াবেটিস : এ রকম ডায়াবেটিস গর্ভকালীন সময়েই প্রথম ধরা পড়ে বা এ সময়ই প্রথম দেখা দেয়। এছাড়া অন্য কিছু কারণেও ডায়াবেটিস হতে দেখা যায়।

টাইপ১ ডায়াবেটিস প্রথমবারের মতো নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বা দেশের ভেতর বিভিন্ন এলাকা বা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে বিভিন্ন রকম সংখ্যা দেখা যায়। ১ বছর বয়সের কমবয়সী শিশুদের ডায়াবেটিস হতে দেখা যায় না। ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ডায়াবেটিসে ভোগার বেশ প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। টাইপ১ এর কারণ হিসেবে জিন (এবহব) ঘটিত অটোইমিউন ডিসঅর্ডার (দেহের রোগ প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্য ওয়ালা কোষগুলো দেহের প্রোটিনকে চিনতে ভুল করে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে)। পরিবেশগত কারণ (ভাইরাস সংক্রমণ-মাম্পস, কক্সাকি ইত্যাদি) কাজ করে। রক্তে কিটো এসিডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া টাইপ১ ডায়াবেটিসের প্রধান ও ভয়াবহতম জটিলতা। এতে অনেকের মৃত্যুও হয়। পৃথিবীর কিছু কিছু দেশে টাইপ১ ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৯৮-২০০১ এই ৩ বছর আগের ৩ বছরের চেয়ে শতকরা ৪০ ভাগ টাইপ১ ডায়াবেটিস হতে দেখা গেছে।

শিশুদের সাধারণত টাইপ২ ডায়াবেটিস হয় না। তবে উন্নয়নকামী দেশগুলোর মানুষের দৈহিক স্থূলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে টাইপ২ ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। এসব দেশে টাইপ২ ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যা টাইপ১ ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যার আটগুণ। ফাস্টফুড জাতীয় খাবারের প্রতি ক্রমবর্ধমান আসক্তি (কোকাকোলালাইজেশন), কম হারে দৈহিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করা দেহের আকার-আকৃতি ও ওজন বাড়ায় এবং পরিণামে টাইপ২ ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এখানে ইনসুলিনের পরিমাণ হয়ত স্বাভাবিক বা তার চেয়ে বেশি থাকছে; কিন্তু দেহের কোষীয় পর্যায়ে ইনসুলিন ডায়াবেটিস হওয়ার একটি প্রধান কারণ।

বাংলাদেশে বারডেম ছাড়া ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও গবেষণার আর কোন প্রতিষ্ঠান নেই। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে যদি তালিকা তৈরি করা হতো, তবে অনেক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশু-কিশোরকে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা যেত। আমাদের দেশে যেসব কিশোরের ডায়াবেটিস শনাক্ত করা গেছে তারা পিডিপিডি শ্রেণীর এবং তাদের অগ্ন্যাশয়ে পাথর ছিল। এটাও দেখা যাচ্ছে, দিন দিন শিশু-কিশোরদের মধ্যে টাইপ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি আতঙ্কজনক।

শিশুদের ডায়াবেটিসের লক্ষণাদি বড়দের মতোই। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রকট হলো ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, অধিক পিপাসা ও ক্ষুধা পাওয়া, দৈহিক দুর্বলতা ও খাওয়ার রুচি বেশি থাকা সত্ত্বেও ওজন কমতে থাকা ইত্যাদি। শিশুর বেড়ে উঠার সময়ের মধ্যে কোন একবার যদি ডায়াবেটিস হয় তবে তা যেমন তাকে সারা জীবন বহন করতে হবে তেমনি এই ডায়াবেটিস তার দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধিকে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। এর ফলে তার বয়োসন্ধিকালও দেরিতে আসতে পারে। শিশু-কিশোরদের ডায়াবেটিস চিকিৎসা করার আগে ৪টি লক্ষ্য স্থির করা হয়।

(১) ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিসের ক্ষেত্রে নিরাপদ ও জটিলতামুক্ত আরোগ্য লাভের ব্যবহার করা

(২) রক্তের গ্লুকোজ খুব বেশি যেন না কমে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া

(৩) দীর্ঘস্থায়ী জটিলতা যতটা কমানো যায় তার ব্যবস্থা করা

(৪) শিশুর স্বাভাবিক দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধির জন্য যতটা সম্ভব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া।

ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘসূত্রী রোগ। এটা যে কতটা জটিলতা তৈরি করতে পারে তা এখনও পুরোপুরি নির্ধারিত হয়নি। কিন্তু দেহের এমন কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই যা ডায়াবেটিসের জটিলতায় আক্রান্ত হয় না। উদাহরণস্বরূপ দৃষ্টিশক্তি হারানো বা অন্ধত্বের প্রধান কারণ হলো ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস থেকে রেটিনোপ্যাথি, নেফ্রোপ্যাথি ও নিউরোপ্যাথি হয়। হৃদপিন্ডের ধমনীর অসুখ, হার্ট অ্যাটাক হতে পারে, বিভিন্ন রকম কর্মবিরোধী প্রক্রিয়া চালু থাকায় ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। শিশু-কিশোরদের টাইপ২ ডায়াবেটিস হলে বয়স্কদের মতো তারাও হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকসহ আরও কিছু ভয়াবহ পরিণতির শিকার হয়। আর এসব জটিলতা বেশ কম বয়সেই দেখা দেয়। এসব সমস্যা শিল্পোন্নত দেশগুলোতে আরও প্রকট। সেসব দেশে এমন ভয়াবহতার হাত থেকে জনগণকে বাঁচানোর জন্য জীবনযাপনের মৌলিক পরিবর্তনের (খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, নিয়মিত ব্যায়াম ও ধূমপান ত্যাগ ইত্যাদি) পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশের শিশুরাও এ ধরনের সমস্যায় ভোগে। অভিজাত শ্রেণীর স্থূলকায় শিশুরা টাইপ২ ডায়াবেটিসে অনেক বেশি আক্রান্ত হয়। নাদুস-নুদুস হওয়া ও শারীরিক পরিশ্রম না করা আভিজাত্য ও সুস্বাস্থ্যের লক্ষণÑ এরূপ ভ্রান্ত ধারণা মূল্যবান শিশুদের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু কিছু এলাকা এবং আফ্রিকা ও জ্যামাইকাতে বিশেষ কিছু ধরনের ডায়াবেটিস দেখা যায়। আগে এটিকে অপুষ্টিজনিত ডায়াবেটিস বলা হতো। এদের মধ্যে আবার দুই শ্রেণীর রোগী আছে। একশ্রেণীর রোগীর এফসিপিডি (ফাইব্রেট ক্যালকুলাস প্যানক্রিয়েটিক ডায়াবেটিস) বলে। অন্য শ্রেণীর রোগীরা পিডিপিডি (প্রোটিন ডেফিসিয়েন্সি প্যানক্রিয়েটিক ডায়াবেটিস) দলভুক্ত। এফসিপিডি শ্রেণীর রোগীর অগ্ন্যাশয়ে পাথর থাকে; কিন্তু পিডিপিডি শ্রেণীভুক্তদের অগ্ন্যাশয়ে পাথর হয় না। এ ধরনের রোগী খুব হালকা-পাতলা হয় এবং এদের দেহে অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা যায়। অনেকের চোখে ছানিপড়া ও স্নায়ুবিক দুর্বলতা থাকে। তাদের চিকিৎসার অধিক মাত্রায় ইনসুলিন ইনজেকশন হিসেবে দিতে হয়। তবে তাদের ডায়াবেটিসের তীব্রতার তুলনায় রক্তে কিটো এসিড বৃদ্ধির পরিমাণ কম। এ রোগের প্রকৃত কারণ জানা যায়নি, তবে প্রচেষ্টা চলছে। এই গবেষকদলে আমাদের বারডেমের স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরাও আছেন।

পরিবেশজনিত কারণগুলো ছাড়াও গর্ভকালীন মায়ের অপুষ্টি, কম ওজন নিয়ে জন্মানো ইত্যাদি কারণও দিন দিন গুরুত্ব পাচ্ছে। আমাদের দেশে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ নবজাতক আড়াই কেজির কম ওজন নিয়ে জন্মায়। বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক লোকের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছোট ছোট রক্তনালীর অসুখ এবং স্ট্রোকের অন্যতম কারণ হলো ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস রোগীর জীবাণুর সংক্রমণ হলে সহজে সারে না। ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ের পাতায় ঘা হওয়া ও সে ঘা সহজে সেরে না উঠা একটি কঠিন সমস্যা। ডায়াবেটিসের সঙ্গে যদি উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তের লিপিডের পরিমাণ বেশি থাকে, তবে তা ভয়ঙ্কর কোন অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে রোগীকে। তাই ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসায় রোগীকে ধৈর্যশীল হতে হবে। ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক পুষ্টি পরিকল্পনা। প্রথমবার যাদের ডায়াবেটিস আছে বলে শনাক্ত করা হয় তাদের অন্ততপক্ষে অর্ধেক শুধু সঠিক পুষ্টি এবং সুষ্ঠু, উপযোগী ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। বাকি অর্ধেকের রক্তে গ্লুকোজ কমানোর জন্য মুখে খাবার ট্যাবলেট লাগতে পারে। তাদের সবার জন্যই পরিমিত ও নিয়মিত ব্যায়াম অপরিহার্য। কারও কারও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ত্বকের নিচে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন প্রয়োজন হতে পারে। তবে ওষুধ যে রকমই নেয়া হোক না কেন খাওয়া-দাওয়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলা এবং নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যায়াম করা সবচেয়ে জরুরি। জীবনযাপনকে একটি সুশৃঙ্খল ধারার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে, যা পরবর্তী সারাটা জীবন পালনীয়। জীবনঘাতী জটিলতা এড়ানোর জন্য রোগের শুরুতেই চিকিৎসা শুরু“করে দিতে হবে। আমাদের দেশে যেসব শিশু-কিশোর ডায়াবেটিসে ভোগে, তাদের বেশিরভাগই ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা নিয়েই প্রথমবার চিকিৎসকের কাছে যায়Ñ এর ফল যথেষ্ট ভাল হয় না। সঠিক চিকিৎসা ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপন ও পরিমিত পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারলে ডায়াবেটিস আক্রান্ত শিশু-কিশোররাও প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। তাই এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন থাকা জরুরি।

 

LEAVE A REPLY